আজ ২১ শে এপ্রিল ২০২০। দেখতে দেখতে সাধারন ছুটির প্রায় এক মাস হতে চলল । দেশে কোথাও লক ডাউন ,কোথাও আংশিক লক ডাউন । লক ডাউন শব্দটির সাথে দেশের মানুষ মনে হয় এর আগে অতটা পরিচিত ছিল না । করোনা ভাইরাস এসে কিছু কিছু শব্দের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে । পিপিই, কীট,মাস্ক,গ্লভস,স্যানিটাইজার,স্টে এট হোম,সামাজিক দূরত্ব,ভ্যান্টিলেটর এরকম আরো অনেক শব্দ এখন আমরা সব সময় ব্যবহার করি ।
করোনা ভাইরাস এসে পুরো পৃথিবীর গতি যেন বদলে দিল । মানুষ এক অদৃশ্য ভাইরাসের ভয়ে ভীত আজ ।
সাধারন ছুটি পেয়ে মানুষ যে যার মত বাড়িতে চলে গিয়েছে এবং এখনো যাচ্ছে । যদিও লক ডাউনের উদ্দেশ্য হল যে যেখানে বসবাস করে ,সেখানেই অবস্থান করা । সরকার যখন ছুটি ঘোষণা করলো তখন তেমন কোন পদক্ষেপ নেয় নি ,ফলে মানুষ গ্রামের দিকে ছুটেছিল । আমি আগে থেকেই ভেবেছিলাম বাড়িতে যাব না ,তাই বাড়িতে যাই নি । তাছাড়া মার্চের ২৭ তারিখেও অফিস করেছিলাম ।
ওদিকে এপ্রিলের ৩- ৪ তারিখের দিকে পোশাক শিল্পের অনেক শ্রমিক বাড়ি থেকে আবার গাজীপুর এ এসেছিল । ৫ তারিখে অফিস খোলার কথা ছিল । বিজিএমইএ আগে থেকে কিছুই বলেনি , ওদিকে বানিজ্য মন্ত্রী বলেছিল স্বাস্থ্য সরক্ষার নিয়ম মেনে কারখানা খোলা রাখা যাবে ।
কেউ কোন দায় নিতে চায় না । একে অপরের উপর দায় চাপাতে ব্যস্ত । ৪ তারিখ রাতে বিজিএমইএ এর সভাপতি ঘোষনা দিয়েছিলেন ১৪ তারিখ পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকবে । ততক্ষনে লক্ষ লক্ষ মানুষ গাজীপুরে চলে এসেছে । শেরপুর,নেত্রকোনা,জামালপুর,ময়মনসিংহ থেকে কেউ কেউ পায়ে হেটে এসেছিল ।
এক জটিল পরিস্থির সৃষ্টি হল । করোনা সংক্রমনের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেল । পরদিন লোকজন আবার যে যার মত গ্রামের দিকে ছুটলো । কেউ কেউ থেকে গেল । অল্প কয়েকটা বাদে বেশির ভাগ কোম্পানী বেতন দেয় নি । সারা দেশে একটা হযবরল অবস্থা ।
দেশে এখনো যেহেতু করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তেমন বাড়ে নি ,লোকজন তাই লক ডাউনের কথায় পাত্তা দিচ্ছে না । আমরা বাঙালি প্রতিটা কাজেই অতি উৎসাহী । পুলিশ দেখলে লোকজন ঘরে ঢোকে ,আবার পুলিশ চলে গেলে বাহিরে বের হয় । সারা বিশ্ব যখন করোনা নিয়ে চিন্তিত তখন এদেশের মানুষ মজা নিচ্ছে । করোনা ভাইরাস নিয়ে কত রকমের গুজব ছড়াচ্ছে । টিকটক ভিডিও তৈরি করছে । কত রকম গল্প তৈরি হচ্ছে । দেশে চলছে নাম মাত্র লক ডাউন ।
যারা বাড়িতে গেছে তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে । দেশের লোকজন করোনাকে ততটা পাত্তা দিচ্ছে না । আর দেবেই বা কেন ? যখন দেশের বড় বড় নেতারা বলে তারা করোনার চেয়ে শক্তিশালী তখন সাধারন জনগন তো নিজেকে শক্তিশালী ভাবতেই পারে ।
আমি বাড়িতে গেলাম না তার কিছু কারণ রয়েছে । প্রথমত বাসের মধ্যে গাদাগাদি করে যেতে হতো । কার কাছে ভাইরাস আছে সেটা জানা মুশকিল । দ্বিতীয়তঃ বাড়িতে গিয়ে নিজ দায়িত্বে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে । তৃতীয়তঃ বাড়িতে ভাতিজা ভাতিজি রয়েছে বিশেষ করে ভাতিজি ছোট মানুষ ,বাড়িতে গেলে সব সময় আমার কাছেই থাকে , তাকে সরাতে না পারলে সমস্যা হতে পারে । চতুর্থঃ কখন অফিস খুলবে বলা যাবে না । এমনিতে এ মহামারির পর দেশে অনেক লোক বেকার হয়ে যাবে এবং ইতিমধ্যে অনেক কোম্পানী বন্ধ হয়ে গেছে । মহামারি আজ হোক কাল হোক একদিন থেমে যাবে কিন্তু বেঁচে থাকলে জীবিকার দরকার । তাছাড়া বিয়ে সাদী এখনো করি নি, বেকার হয়ে গেলে অনেক সমস্যা হবে । মহামারির পর কোম্পানী গুলো লোক ছাটাই শুরু করবে এবং ইতিমধ্যে সেরকম অনেক খবর পাওয়া যাচ্ছে । অফিস খুললে অনুপস্থিত থাকা যাবে না । কখন কোন ভুলে জব চলে যাবে বলা যায় না ।
সব দিক বিবেচনা করে বাড়িতে গেলাম না । আমার সাথে এক ভাতিজা আর এক ভাই আছে । ওরাই রান্না করে খাওয়ায় ,সেজন্য খাওয়া দাওয়ায় সমস্যা নেই। প্রতিদিন রান্না নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা চালানো হয় । বিভিন্ন রকম আইটেমের কথা বলি ,তারা রান্না করার চেষ্ঠা করে । ইতিমধ্যে আমিও পুরি,সিঙ্গারা নিজ হাতে তৈরি করেছি । মার্চের ২৭ তারিখ হতে ববিতার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হয়েছে । তার সাথে অনেক সময় কেটে যায় । গত বছর তাকে দেখতে গিয়েছিলাম ,কারন বশতঃ আর আমাদের বিয়ে হয়নি । এবার আবার নতুন করে যোগাযোগ শুরু হয়েছে । প্রায় দিন সন্তোষের সাথে কথা বলা হয় । দিপ্তী বিয়াইনের সাথে ,ভাতিজা সুপ্রিয় ও পলাশ ভাতিজার সাথে নিয়মিত মেসেজ আদান প্রদান হয় ।
আমেরিকায় লিটন ভাই ও ছোট ভাই হরলালের সাথে,ভারতে বিয়াই মিঠুন ও ভাতিজা সুশীলের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে । রুমমেট মানিকদা,কলিগ সজীবদা,অফিসের এডমিন ম্যানেজার বিদ্যুৎদা,কল্যাণ কর্মকর্তা কবিতা দি,জাহাঙ্গীর ভাই,অনিক,পঙ্কজ এর সাথে যোগাযোগ হয় ।
বন্ধু রমানাথের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ হচ্ছে । বাড়িতে মা,দাদা,বৌদি ,ভাতিজা ও ভাতিজির সাথে কথা বলি নিয়মিত । গোলাপী ও শেফালী বিয়াইনের সাথেও যোগাযোগ হয় । নিমোজখানার সান ও ডোমারের দেশ নামক স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের উপদেষ্টা বানিয়েছে আমাকে । ত্রান,লিফলেট,মাইকিন সহ অনেক কাজ করে যাচ্ছে সংগঠন দুইটি । ওদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেও সময় কেটে যায় ।
করোনার কারনে টপির সাথে যোগাযোগ কমে গেছে । সে বাড়িতে গেছে মাদারীপুর ও ফরিদপুর লক ডাউনের সময় । আমি নিয়মিত মেসেজ করি । মেসেজ দেখেও কোন উত্তর পাই না । এমন মহামারী আর বিপদের দিনে যদি কেউ খোঁজ খবর না রাখে তাহলে রাখবে টা কবে ?
অনেক বার মেসেজ করি । কোন উত্তর নেই । তারপর মোবাইলে কয়েক বার কল দিয়েছিলাম । সে নিজেকে ব্যস্ত দেখায় ।
ভেবেছিলাম এবার বিয়ের ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব । দেখি সে বিষয়ে তার আগ্রহ কম । এমন ভাব দেখায় ,তাকে ছাড়া আর কাউকে আমার পছন্দ হবে না । বার বার আমার কথাকে নাকোচ করে দেয় । এবার এমন বিপদের সময়েও সে আমার প্রতি উদাসিন । সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাসের জন্য মানুষ ভয়ে ভীত । আমেরিকা,ইতালি,স্পেইন,ফ্রান্স এর মত দেশ কিছুই করতে পারছে না । দিনে দিনে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ,সেই সাথে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা । সবার মনে ভয়,চিন্তা যে আমরা বাঁচব কিনা । এমন বিপদের দিনে যারা খোঁজ খবর রাখে ,খবর নেয় তারাই তো প্রকৃত বন্ধু,আত্মীয়,শুভাকাঙ্খী । ভালই হয়েছে টপি আমার খবর না নিয়ে । অন্তত বেঁচে থাকলে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারব ,তাকে আর জীবন সঙ্গী করব না ।
ববিতার সাথে ধীরে ধীরে অনেক কথাই শেয়ার হচ্ছে । সে এবার অনার্স ৩য় বর্ষে । তার চিন্তা ভাবনার সাথে আমার চিন্তা ভাবনার অনেক মিল খুঁজে পাচ্ছি । যতই কথা বলছি ততই দু'জনের মধ্যে অনেক মিল খুঁজে পাচ্ছি । গত বছর আমাদের বিয়ে হলে হয়তো একে অপরের সম্পর্কে এত কিছু জানা যেত না । যা হয় ভালোর জন্যই হয় ।
যখন ইতি নামের মেয়েটির সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পথে,তখন তার সাথে বেশ কিছু দিন কথা বলেছিলাম । সত্যি বলতে কি,কথা বলে শান্তি পাই নি । দেখতে ভাল ছিল কিন্তু তার সাথে কথা বলে আরাম পাইনি । কথার সাথে কথার মিল পাইনি । ভেবেছিলাম,বিয়ে হলে এভাবেই সারা জীবন মানিয়ে নিতে হবে । ভাগ্যিস বিয়ে হয় নি । ইতিদের ছিল যৌথ পরিবার । তার বাবা,দুই কাকার পরিবার মিলে এক সাথে সবাই একই বাড়িতে থাকে । রান্নার কথা জিজ্ঞেস করাতে সে বলেছিল,কেউ আমাকে রান্না করতে দেয় না । আমার মা,দুই কাকীমা রান্না করে । আমি একাদশীর উপবাস করি শোনার পর বলেছিল ,সে নাকি উপবাস করতে পারবে না ।
আমি ভোজন প্রিয় মানুষ,একটু ধর্মভীরু টাইপের । আমার স্ত্রী যদি ওরকম হয় ,তাহলে ভবিষ্যৎ কি রকম হতে পারে ? ঈশ্বর যা করেন ,ভালর জন্যই করেন , আগেও বিশ্বাস করতাম ,এখনো করি আর ভবিষ্যতেও যেন করতে পারি ।
সে হিসেবে ববিতার সাথে আমার চিন্তা ভাবনা গুলোর মিল খুঁজে পাচ্ছি । সে মেসেজ এর মাধ্যমে যে ভাবে আমার মেসেজ এর উত্তর দিচ্ছে,তার চিন্তা ভাবনার কথা গুলো প্রকাশ করছে ,সেটা আমার মত লোকের জন্য উপযুক্তই বটে ।
সব মিলিয়ে সাধারন ছুটির দিন গুলো ভালই কাটছে । এ মাসের ১১ তারিখে অফিসে গিয়েছিলাম । ১২ তারিখে মাওনায় গিয়েছিলাম বাগান বাড়ির গরুর খাদ্য কেনার জন্য । তারপর মূলতঃ বাসায় রয়েছি । দরকার ছাড়া বাইরে বের হই না । সারা দিন মোবাইলে খবর দেখি,গান শুনি । দিন দিন দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে । আজ পর্যন্ত তিন হাজার পেরিয়ে গেল আক্রান্তের সংখ্যা ,মৃতের সংখ্যা একশো পেরিয়েছে । সাধারন ছুটি ২৫ তারিখ পর্যন্ত । জানি না কবে থামবে এ মহামারী । কবে ফিরে পাব সেই চিরচেনা পরিবেশ । সবাই যেন অজানা ভয়ে ভীত । হঠাৎ করেই সব কিছু কেমন যেন থেমে গেছে ।
অদেখা এক ভাইরাসের কাছে মানুষ পরাজিত হচ্ছে । নিমিষেই মানুষের গর্ব,অহংকার পরাজিত হয়ে গেছে ।
তবুও এদেশে প্রতিনিয়ত ত্রানের চাউল চুরির খবর পাচ্ছি । তেল চুরির খবর পাচ্ছি । মানুষ কি ভাল হবে না । ডাক্তাররা চেষ্ঠা করেই চলছে , নার্সরা সেবা দিচ্ছে । পুলিশ,আর্মি,সাংবাদিক সহ অন্যান্য পেশার মানুষ দিনরাত পরিশ্রম করছে । তারপরেও কিছু মানুষ আইন মানছে না । আমরা অপেক্ষায় রয়েছি কবে সুদিন ফিরে আসবে । ঘরে থাকা আর ঈশ্বরের উপর ভরসা করা ছাড়া আপাতত করার কিছুই নেই ।
0 Comments