স্কুলে না গেলে ভর্তা ভাত খেয়ে শুয়ে থাকতাম । শুয়ে শুয়ে নানা রকম কল্পনা করতাম আর কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতাম । কখন বৈঠকখানা বা বাট ঘরায় আড্ডা জমাতাম । চৌপাতি ,চক্রচাল,পাইট ,লুডু সহ নানা রকম খেলা খেলতাম ।
কখনো দল বেধে পাট ক্ষেতের মধ্যের সরু আইল ধরে অনেক দূরে এগিয়ে যেতাম । কখনো দেখতাম আইলের ধারে কোন মাছ পাওয়া যায় কি না । পাট ক্ষেতে মাগুর,শিং আর টাকি মাছ বেশি পাওয়া যেত । তখনকার দিনে আমাদের এলাকায় প্রচুর পাট চাষ হত ।
আউশ নামে এক প্রকার ধান আবাদ হতো । লোকাল ভাবে সেই ধানকে ভাদোই ধান বলা হতো ।
বর্ষার জলে আউশ ক্ষেত জলে যেত । পাট ক্ষেতে বৃষ্টির ধারা অন্যরকম দৃশ্যের অবতারনা করতো । কেউ কেউ ঝাপি মাথায় দিয়ে হাল চাষ করতো । বৃষ্টি বেশি হলে কেউ আর মাঠে থাকতো না । সবাই যে যার বাড়িতে অবসর সময় কাটাতো ।
কখনো কখনো স্কুলে যেতাম । গিয়ে দেখতাম ছাত্র ছাত্রী বেশি আসতো না । আমরা পড়ার চেয়ে বেশি গল্প আর খেলায় মন দিতাম । কলম দিয়ে টোকাটুকি খেলতাম । নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে অনেক আগেই স্কুল ছুটি হতো । আমরা দল বেঁধে বর্ষার জল মাড়িয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিতাম ।
বাড়িতে আসার সময় কোথায় ব্যাঙ ডাকে সেটা দেখতাম । কখনো কদম ফুল গাছ থেকে পাড়তাম । কার গাছে কালোজাম ধরেছে সেটা খুঁজতাম ।
বৃষ্টির দিনে পড়াশোনার বালাই ছিল না । দল বেঁধে বৃষ্টির জলে ভিজতাম । বৃষ্টি কমে গেলে কলা গাছ দিয়ে কলাগাছের ভুড়া বা ভেলা বানাতাম । সেই ভেলায় চড়ে কেটে যেত অনেক সময় ।
বৃষ্টির দিনে কখনো দল বেঁধে নদীর তীরে বেড়াতে যেতাম ।
স্কুলে যেতাম বড় প্লাস্টিকের বস্তা মাথায় দিয়ে,কখনো মান কচুর পাতা বা কলা গাছের পাতা মাথায় দিয়ে । তখন কাঠের হাতল ওয়ালা ছাতা দু একটা বাড়িতে থাকতো । সবার বাড়িতে আবার সেটাও থাকতো না । ছাতাতে আমাদের অধিকার ছিল সবার পরে ।
এখনকার মত এত বাহারি টাইপের ছাতা সে সময় আমরা দেখি নি । আমার এ লেখা পড়ে অনেকেই হয়তো গাল গল্প মনে করতে পাড়ে , কিন্তু এটাই ছিল বাস্তব ঘটনা ।
কখনো কখনো টানা কয়েক দিন বৃষ্টি পড়তো । তখন আমরা কয়েক জন মিলে বৈঠক খানা বা বাট ঘরে নানা রকম খেলা খেলতাম । মার্বেল,লই,লুডু,চৌপাতি,চক্রচাল,পাইট সহ নানা রকম খেলা খেলতাম । মেয়েরা খেলতো ফুল্লন,কুতকুত । কখনো আমরা চোর পুলিশ খেলতাম ।
বড়রা বসাতো তাস বা হুকোর আড্ডা । নয়তো দিন ভর চলতো গল্পের আসর । সে সময় বিনোদন বলতে গল্পের আসরই প্রসিদ্ধ ছিল । তখন রেডিও ,টেলিভিশন দূর্লভ ছিল । আমাদের পাড়ায় কয়েক জনের বাড়িতে শুধু রেডিও ছিল । আমাদের বাড়িতে একটা ওয়ান ব্যান্ড ফিলিপস্ কোম্পানির রেডিও ছিল ।
বড়দের হুকোর আড্ডাটা বর্ষার দিনে খুবই ভাল চলতো । ফাঁকে ফাঁকে মুড়ি চিড়া দিয়ে জলপানের ব্যবস্থাও হয়ে যেত ।
সে সময় লোকজন খুবই আমোদে জীবন কাটাতো । এখনকার মত এত কর্ম ব্যস্ততা ছিল না । মানুষ খুবই আন্তরিক ছিল ।
এখন কর্ম ব্যস্ত জীবনে বর্ষার উপস্থিতি টেরই পাই না । কখন বর্ষা আসে ,কখন যায় অনেক সময় বুঝতেই পারি না ।
সকাল হলেই দৌড় দেই অফিসের দিকে । বাসায় ফিরি সন্ধ্যায় । অফিসে বসে বৃষ্টির দৃশ্য দেখারও সুযোগ পাই না । গ্রামে যাওয়া হয় বছরে দুই তিন বার । গ্রামে কাটানো বর্ষার সেই দিন গুলোকে বড় মিস করি । মনে মনে উপলব্ধি করি ফেলে আসা সেই দিন গুলোকে । এখনকার দিনে আমাদের মত হয়তো আজকালকার বাচ্চারা বর্ষাকে এমন ভাবে অনুভব নাও করতে পারে । তারা তো ব্যস্ত মোবাইলে । সময় কাটে ফেসবুক,মেসেঞ্জারে । বাইরের প্রকৃতি দেখার সময় কোথায় । তখনকার মত এত নির্মল ,নির্ভেজাল প্রকৃতি দেখার ভাগ্য তাদের হয় কি না আমার জানা নেই ।
0 Comments