তারিখঃ২৭/০৬/২০২১
বর্ষা প্রতিটা মানুষের জীবনেই একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে থাকে ,কিছুটা কম আর কিছুটা বেশি । যারা গ্রামে শৈশব কাটিয়েছে বা গ্রামেই বড় হয়েছে বা আজ অবধি বাস করছে ,তাদের জীবনে বর্ষার প্রভাব শহুরে মানুষদের চেয়ে একেবারে ভিন্ন রকম ।
গ্রামীন জীবনের সাথে বর্ষা জড়িয়ে রয়েছে মায়া মমতায় । দুঃখে ,কষ্টে বা আনন্দে । গ্রামীন বর্ষা যে উপভোগ করেনি ,তারা জীবনে ঋতুর প্রভাব সম্পর্কে অনেক কিছুই মিস করেছে ।
আমার জীবনে বর্ষার যে প্রভাব ,তা লিখার চেষ্ঠা করছি মাত্র ।
এক দম ছোট বেলার কথা মনে না থাকলেও যতদূর মনে পড়ে তারই আজ স্মৃতি চারণ করব । এক সাথে সব কিছু না লিখে কয়েকটি ভাগে বা পার্ট করে লিখব ।
যখন পড়া লেখার হাতে খড়ি হয়নি অর্থাৎ স্কুলে যাওয়া শুরু করি নি,তখনকার কথা লিখব এ স্মৃতি কথায় । ধীরে ধীরে আমার জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ের বর্ষার কথা লিখার চেষ্ঠা করব । সব কথা কলমের কালিতে ফুটিয়ে তোলা যায় না,তবুও যতদূর সম্ভব ,চেষ্ঠা চালিয়ে যাব ।
খুব ছোট বেলায় আমাদের খড়ে ছাওয়া ঘর ছিল । পরে টিনের চাল হল । খড়ের চালে বৃষ্টি পড়লে তেমন শব্দ শোনা যায় না । টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ যেন বাজনার মত মনে হয় ।
ছোট বেলা ঠাকুরমার সাথে ঘুমাতাম । হঠাৎ করে ব্যাঙের ডাকে সকাল বেলা ঘুম ভেঙে যেত । ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে দেখতাম বৃষ্টি আর বৃষ্টি । হঠাৎ করে চেনা প্রকৃতি যেন অন্য রুপ ধারণ করতো ।
আমাদের বাড়িতে সে সময় দুই তিন জন ছেলে থাকতো বছর চুক্তিতে । দেখতাম তারা বাড়ান্দায় বসে বসে দড়ি পাকাতো ,নয়তো মাছ ধরার সরঞ্জাম তৈরি করার জন্য উঠে পড়ে লেগে থাকতো । দড়ি পাকানোর জন্য ঢেড়া আর উটকন নামে দুটো বাঁশের তৈরি যন্ত্র ব্যবহার করতো তারা । কখনো কখনো দেখতাম ঠাকুর মা টাকুরি নামক একটা যন্ত্রের মাধ্যমে চট বানোনোর জন্য চিকন চিকন সুঁতুলি তৈরি করতো ।
কখনো দেখতাম ,পুকুর থেকে ছোট ছোট দারকিনি,পুঁটি মাছ,কৈ মাছ উজানের টানে বাড়ির আঙিনায় এসে পড়তো । আমরা সেই মাছ ধরার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করতাম ।
ঠাকুর দাদাকে দেখতাম হুকো খেতে খেতে কাজের ছেলেদের সাথে গল্প করতো ।
আমরা মুখ ধুয়ে আম ,কাঁঠাল আর চিড়া,মুড়ি বা খৈ খেতাম । বেলা বাড়ার সাথে সাথে গোয়াল ঘর থেকে ছাগল ডাকতে শুরু করতো । আজ গরু,ছাগল গোয়ালে বাঁধা ।
কখনো আস্তে বৃষ্টি পড়তো ,কখনো মষুল ধারে । সে সময় আমাদের আশে পাশের প্রতিটা বাড়িতেই বাট ঘরা বা ডাইঘরা বা বৈঠক খানা বা টঙ ঘর ছিল । সেই বৈঠক খানায় জমতো বড়দের গল্পের আসর । চারিদিকে বৃষ্টির ঘনঘটা । পাট ক্ষেতে বৃষ্টির মাদকতা তৈরি হতো । কাক পক্ষিরা বৃষ্টির জলে ভিজে জবুথবু হয়ে থাকতো ।
মাঝে মাঝে ব্যাঙের দল কোরাস গেয়ে উঠতো । কেউ কেউ জাল বা মাছ ধরার ফাঁদ পেতে মাছ ধরতো । সেই মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার মজাটাই অন্যরকম । বৃষ্টি কমে আসলে সমবয়সীদের সাথে ঘুরতে বের হতাম । কোথায় ব্যাঙ ডাকছে ,কোথায় জল বেড়েছে ,কোথায় মাছ ধরার জন্য ফাঁদ পাতা হয়েছে এসব দেখে বেড়াতাম । আমি ,চন্দ্রদা,কার্তিক,মনো এদের সাথেই বেশির ভাগ ঘুরতাম ।
জল একটু বেশি হলে কলা গাছের ভুড়া বা ভেলা বানিয়ে চড়তাম ।
বর্ষার জলে আবাদী জমি গুলো থৈ থৈ করতো । আমরা হেটে হেটে বাড়ির পশ্চিম পাশে ছোট নদীটার কাছে যেতাম । ওটাকে আমরা ডাড়া বলি । বর্ষার জলে যৌবন ফিরে পেয়েছে ডাড়াটি । আমরা বাঁশ পাতা দিয়ে নৌকা বানিয়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দিতাম । নদীর বাঁশের সাঁকোটার উপর বসে বসে নদীর ফেনা তোলা ঢেউ দেখতাম ।
সারাদিন বৃষ্টি হলে কয়েক জন মিলে দিয়াশলাই এর প্যাকেট এর তাস বানিয়ে লই নামে একটা খেলা খেলতাম । কখনো মার্বেল ,কখনো চৌপতি খেলতাম ।
এ বাড়ি থেকে ওবাড়ি যেতাম প্লাসটিকের বস্তা মাথায় দিয়ে ,কখনো পলিথিন ,কখনো মানকচুর পাতা ,কখনো বা সুপারির খোল মাথায় দিয়ে । তখন বাঁশ এর পাতি আর প্লাস্টিক দিয়ে ঝাপি নামে একটা ছাতার মত জিনিস আমাদের এলাকায় ছিল ।
বেশির ভাগ বাড়িতে ছাতার বিকল্প হিসেবে ওটা ব্যবহার করা হতো ।
কখনো কখনো পুকুরে নেমে নানা রকম জলকেলি খেলা খেলতাম । গ্রামের ছেলে তাই সাঁতারটাও শেখা হয়ে গেছে । কখনো বৃষ্টির জলে ভিজে আনন্দ করতাম । আহা কত মধুর ছিল সেই দিন গুলি । আজ বার বার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে শৈশবের সেই দিন গুলির কথা ।
বর্ষার সেই দিন গুলি কখনো আর ফিরে আসবে না জীবনে ,কিন্তু স্মৃতি গুলো রয়ে যাবে হৃদয়ের গহিনে ।
0 Comments