আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখতাম বাড়িতে ওয়ান ব্যান্ডের একটি ফিলিপস্ রেডিও । শুনেছিলাম আমার জন্মের আগেই নাকি আমার বাবা সেই রেডিও খানা কিনেছিলেন । বাড়ির চারিপাশে অনেক তেজপাতার গাছ ছিল । তেজপাতা বিক্রির টাকা দিয়ে নাকি তখন কার দিনে সাড়ে চারশ টাকা দিয়ে রেডিওটা কিনেছিল বাবা ।
সেটা ১৯৮৩-৮৪ সালের কথা হবে । সে সময় গ্রামের দুই একটা বাড়িতে রেডিও আর সাইকেল দেখা যেত । বিনোদন বলতে গ্রামের পালা বা পালাটিয়া গান,যাত্রা,তুকখা,কবি গান এসব ছিল আমাদের এলাকার প্রধান বিনোদন । সেই সব ছিল নির্মল বিনোদন । কোন রকম বাহুল্যতা ছিল না । গ্রামের সহজ সরল মানুষ সহজ সরল বিনোদনে খুশি ছিল ।
নব্বই দশকের দিকের কথা । আমি তখন প্রাইমারী স্কুলে পড়ি । বগলে বই খাতা নিয়ে,খালি পায়ে স্কুলে যেতাম । তখন কেউ স্যান্ডেল বা জুতা পড়ে স্কুলে যেত না । যারা হাই স্কুলে পড়তো তারা শুধু স্যান্ডেল পড়ে স্কুলে যেত । কাউকে কাঁধে করে ব্যাগ নিয়ে যেতে দেখা যেত না ।
বাড়িতে রেডিও থাকায় প্রচুর গান,বাজনা,বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠান শুনতাম । রবি বার আর বুধবার সন্ধ্যায় সিলিগুড়ি আর কলকাতা বেতারে যাত্রা হতো । সোমবার কলকাতা বেতারে তরজা কবির গান হতো । মাসের শেষ মঙ্গল বার রংপুর বেতারে পালাগান হতো । ঠাকুরগাঁ বেতারে বিকালের দিকে ভাওয়াইয়া গান প্রচার হতো । দুপুরের দিকে ঢাকা বেতারে বিভিন্ন রকম সিনেমার বিজ্ঞাপণ প্রচার করা হতো ।
গাজী মাযহারুল সহ বেশ কয়েক জন সিনেমার ধারা ভাষ্য দিতেন । আমরা বেতার কে বলতাম সেন্টার । যেমন ঢাকা ক সেন্টার, ঢাকা খ সেন্টার, রাজশাহী সেন্টার ,ইত্যাদি ।
প্রতিদিন রাত সাড়ে সাতটায় ঢাকা ক সেন্টারে প্রচারিত হতো সৈনিক ভাইদের জন্য দূর্বার অনুষ্ঠান । এক একদিন এক এক রকম গান দিয়ে সাজানো হতো দূর্বার অনুষ্ঠান ।
নিশুতি অনুষ্ঠান,অনুরোধের আসর চাওয়া পাওয়া সহ বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠান ছিল । বিভিন্ন রকম ধারাবাহিক নাটকও প্রচার করা হতো । মানিক চান্দের কিসসা নামে একটি নাটকের কথা আজও মনের মধ্যে গেঁথে রয়েছে ।
সে সময় সন্ধ্যা বেলা অনেকেই আসতো রেডিওর অনুষ্ঠান শোনার জন্য । দেশের খবরাখবর শুনতাম রেডিরও মাধ্যমে । রেডিও ছাড়া তেমন কোন মাধ্যমই ছিল না আমাদের এলাকায় ।
বাড়িতে রেডিও থাকার সুবাধে অনেক কিছু জানতে পেরেছি ,শিখতে পেরেছি । বিভিন্ন রকম তথ্য উপাত্ত জানতে পেরেছি ছোট কালেই । কন্ঠ শুনেই বলে দিতে পারতাম কোন শিল্পী গান গাচ্ছে ।
আয়েশা সরকার,গঙ্গা চরণ বিশ্বাসের মত অনেক শিল্পীর গান শুনতাম নিয়মিত ।
কচি উদ্দিন,কুটির মনসুর,ভূপতি বর্মনের গান শুনে অনেক আনন্দ পেতাম ।
সে সময় রেডিও পেয়েই অনেক খুশি ছিলাম । সবার বাড়িতে রেডিও ছিল না । গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে রেডিও ছিল ,তার মধ্যে আমাদের বাড়িতে ছিল একটি ।
এখন সময় অনেক বদলে গেছে । যুগের অনেক পরিবর্তন হয়েছে । রেডিওর কথা হয়তো অনেকেই জানে না । নানা রকম যন্ত্রপাতি আবিস্কার হয়েছে । ইন্টারনেট,গুগল,ফেসবুক,ইউটিউব,টিকটক,লাইকি,ইনস্ট্রাগ্রাম,টুইটার,হোয়াটসআপ এসেছে ।
কিন্তু আমাদের সময়ে সেই রেডিও আমাদের যে নির্মল বিনোদন দিয়েছিল, এখনকার প্রজন্ম কি সেই রকম আনন্দ পাচ্ছে । মাঝে মাঝে নিজের মনে নিজেকেই প্রশ্ন করি ।
কেউ মনে রাখুক বা না রাখুক কিন্তু আজও আমার মনের মধ্যে ছোট কালের সেই রেডিওটার কথা সোনালী অক্ষরে লিখা রয়েছে । এখনও ভাবি সেই রেডিওটার কথা ।
0 Comments