তারিখঃ ১৮/০৩/২০২২ ইং
সে দিনও ছিল এমনি দোল উৎসবের রাত । সেটা ২০১১ সালের কথা । আমি,চন্দ্রদা আর সুশীল গিয়েছি নয়নদার বাড়িতে । কালী পুজার অনুষ্ঠান ছিল । নয়নদা বেশ কয়েক বছর ধরে দোল পূর্ণিমায় কালী পূজা করে আসছেন ।
আমরা বেশ কয়েক জন বসে গল্প করছি । আগে দেখতাম পাড়ায় প্রতি বছর দোল উৎসব হতো । তখন আমরা খুবই ছোট । কখনো খগেন মেম্বারের বাড়িতে,কখনো মদনদার বাড়িতে । আমাদের পাড়া দুইটি দলে বিভক্ত ছিল । ওদিকে হতো জিতেনদার বাড়িতে ।
গ্রামের প্রতিটা পাড়ায় সার্বজনীন মন্দির থাকলেও দুঃখের বিষয় হল আমাদের পাড়ায় কোন সার্বজনীন মন্দির নেই ।
আমাদের গ্রাম অনেক বড় এলাকা নিয়ে । গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ হিন্দু । অন্যান্য পাড়ার চেয়ে আমাদের পাড়ার জনসংখ্যা তুলনা মূলক অনেক কম । জনসংখ্যা কম হলে কি হবে , গ্রামের বাজারে আমাদের পাড়ার দাপট সবচেয়ে বেশি ।
ক্রমে ক্রমে আমাদের পাড়া থেকে বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠান গুলো বিলুপ্ত হতে শুরু করেছে । ছোট বেলায় দেখতাম এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বড় সরস্বতী পূজা হতো আমাদের পাড়ায় । লক্ষী পূজা হতো আমাদের পাড়ার মোড়ে । অম্বুবাচি,জন্মাষ্টমী,রাধাষ্টমী কত কিছুই না হতো । আজ কালের আবর্তনে সব হারিয়ে যেতে বসেছে ।
এসব কথা কয়েক বছর ধরে আমার মাথায় কেন জানি ঘুরপাক খাচ্ছিল । ছোট বেলা থেকে বাড়ির বাইরে থেকে পড়ালেখা করে আসছি । বাইরের এলাকার কৃষ্টিকালচার দেখে দেখে মনের মধ্যে নানা রকম চিন্তা ভাবনা আসতো ।
ভাবতাম মন্দির একটা প্রতিষ্ঠা করতেই হবে । কারো বাড়ির উঠানে নয় ,সেটা হবে সার্বজনীন মন্দির । নিজস্ব জমির উপর প্রতিষ্ঠা হবে সেই প্রতিষ্ঠান । সেখানে নানা রকম ধর্মীয় অনুষ্ঠান হবে ।
কিন্তু আমার তো টাকা নেই । টিউশনি করি । বাড়ি থেকেও টাকা দেওয়ার মত অবস্থা নেই । আমাদের যেটুকু জমি জায়গা রয়েছে ,সেগুলো নিচু প্রকৃতির ,তাছাড়া সেই জমি গুলো পাড়ার শেষ প্রান্তে । আমি জমি খুঁজছিলাম পাড়ার মাঝামাঝি ।
তো আজ নয়নদার বাড়িতে কথায় কথায় মন্দিরের প্রসঙ্গ তুললাম । বললাম জমি পেলে একটা মন্দির করা যেতে পারে । সেই মন্দির থেকে কি কি হবে তার একটা রুপরেখার কথা বললাম । বললাম সম্পূর্ণ পাড়ার লোককে একত্রিত করতে হবে । কোন বিভেদ রাখা যাবে না । ধর্মীয় দলাদলি রাখা যাবে না । কে কোন মত,পথের সেটা আমাদের দেখার বিষয় না ।
কোথায় মন্দিরটা করলে সবচেয়ে ভাল হয় সেটারও স্থানের কথা বললাম ।
আমার কথা শুনে সুশীল বলল , আমরা তিন শতক জমি দেব । যেমন করেই হোক বাবাকে রাজি করাব । চন্দ্রদার বড় ভাই পতিরাম দাদার জমি রয়েছে ওখানে । চন্দ্রদা বলল দাদার তিন শতক জমি রয়েছে ওখানে । দরকার হলে আমার ভাগের সাথে বিনিময় করে হলে জমি দেব ।
আমি বললাম ওখানে ধনঞ্জয় দা আর জয়হরিদা দুই ভাইয়ের জমি আছে । আমি ওদের কাছ থেকে তিন শতক জমি নিতে পারব । নয় শতক জমি হলে আমাদের মন্দির হয়ে যাবে ।
রাতেই এসে আমরা জমি দেখতে লাগলাম । এক সময় এখানে ঘন বাঁশ ঝাঁড় ছিল । এখন কিছুটা কম । জমিটা উঁচু রয়েছে । আমাদের বাড়ির পূর্ব উত্তরে কাছেই । স্থানটা সবার দারুণভাবে পছন্দ হল । রাত বারোটার পর বাড়িতে আসলাম । শুয়ে শুয়ে অনেক প্লান করতে লাগলাম । কিভাবে কি করা যায় । রাতে আর ঘুম আসে না । একই চিন্তা বার বার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ।
খুব সকালে উঠে বাড়িতে কথাটা বললাম । সবাই শুনে অনেক খুশি । বলল প্রতিষ্ঠান হলে তো অনেক ভাল হয় ।
এরপর গেলাম জয়হরিদাদের বাড়িতে । সব শুনে ওরা এক বাক্যে রাজি ।
এর পর বিরেন তাঐর সাথে সব শেয়ার করলাম । সব শুনে তিনি মহা খুশি । উনি আবার ভোজনীয় ব্যক্তি । এরপর চন্দ্রা,সুশীল সহ পাড়ার প্রতিটা বাড়িতে গেলাম মতামত নেওয়ার জন্য । আমাদের কথা শুনে সবাই খুব খুশি । আমরা ছোট বলে কেউ অবহেলা করে নি ,সবাই সাধুবাদ জানিয়েছিল আমাদের প্রস্তাবকে ।
ছোট বেলা থেকে বাড়ির বাইরে থাকার কারণে পাড়ার অনেক বাড়িতে যাওয়া হয়ে উঠেনি । আশে পাশের যত পাড়া রয়েছে ,সেগুলোর চেয়ে আমাদের পাড়ায় পরিবোরে সংখ্যা সবচেয়ে কম । তেপান্ন থেকে চুয়ান্নটা পরিবার নিয়ে আমাদের পাড়া ।
মন্দির উপলক্ষে প্রতিটি বাড়িতে কমপক্ষে পাঁচবার করে গিয়েছি কয়েক দিনের মধ্যে ।
এরপর একদিন পাড়ার সবাইকে নিয়ে একটা মিটিং এর আয়োজন করা হল । বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়,লোক জন তেমন আসে না । চন্দ্র দাকে বললাম,ঘটনা কি কেউ তো আসে না । আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম ।
ধীরে ধীরে লোকজন আসতে লাগলো । সন্ধ্যায় মিটিং হল ।সুশীল দিবে তিন শতাংশ,পতিরাম দা তিন শতাংশ,ধনঞ্জয়দা আর জয়হরিদা দুই ভাই মিলে তিন শতাংশ , ললিত কাকা,খুশি কান্ত কাকা ও দ্বীনোবন্ধু কাকা তিন ভাই মিলে তিন শতাংশ মোট ১২ শতাংশ জমি ম্যানেজ হল ।
পরে অবশ্য সুশীলের বাবা দুই শতাংশ জমি দিয়েছিল । মোট এগারো শতাংশ জমি হল মন্দিরের নামে ।
পরে আমিন নিয়ে এসে জমি পরিমাপ করা হল । আমি টিউশনির টাকা দিয়ে আমিন দর্শন দার ফি দিলাম । এলাকার মধ্যে দর্শন আমিন নামকরা আমিন । আমাদের বাড়িতেই আমিনের খাবার ব্যবস্হা হল ।
বিরেন তাঐ আর সুশীল সহ আমরা মন্দিরের নাম ঠিক করলাম । মাস্টার পাড়া গীতাঞ্জলি ভাগবত সেবা আশ্রম ।
সবাই মিলে চাঁদা দিয়ে মন্দিরের জমি রেজিষ্ট্রি করা হল । ইসাহাক চেয়ারম্যান একটা সরকারী টিউবওলের বাজেট দিল ।
পহেলা বৈশাখের দিন মন্দিরের ভিত্তি স্থান করা হল ।
প্রতিদিন পুজা অর্চনা চলতে থাকলো । মন্দিরের পূজারীনি হল আমার মা । মন্দির কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হল আমার দাদাকে ।
সবাই আমার প্রশংসা করতে লাগলো । বড় রা যা করতে পারে নি,আমি নাকি তা করে ফেলেছি । আমি মনে মনে ভাবি ,সবি ঈশ্বরের ইচ্ছে ।
আমরা মুষ্ঠি চাউল সংগ্রহের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাটির পাতিল সরবরাহ করলাম ।
সবাই মিলে মাটি কাটলাম । বাঁশ সংগ্রহ করলাম পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে । ধীরে ধীরে মন্দিরের অবকাঠানো তৈরি হতে লাগলো ।
আজ সবার সহযোগিতায় মন্দিরের ৩লা ভিত্তি দেওয়া হয়েছে । ভবিষ্যতে হয়তো ভাল কিছু হবে । তবে সেই পূর্ণিমার রাতের কথা বার বার মনে পড়ে,যে রাতে আমরা মন্দিরের প্রস্তাব করেছিলাম এবং রাতেই স্থান নির্বাচন করেছিলাম ।
0 Comments