স্বার্থের সীমা ও মানবিকতার মূল্য
জীবনে অনেক সময়ে আমরা এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই, যা আমাদের মানবিক সম্পর্কের প্রকৃতি সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবায়। “বৃষ্টি থেমে গেলে ছাতাটাও বোঝা মনে হয়, কাজ ফুরিয়ে গেলে কলমটাও ফেলে দেই”—এই সরল অথচ গভীর উপমাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কত সহজেই মানুষ প্রয়োজন শেষ হলে সম্পর্ক, সাহায্য কিংবা সৌজন্য ভুলে যায়। যেন সবকিছুই স্বার্থের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, আর সেই স্বার্থ ফুরোলেই মানুষের মনের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
মানুষের উপকার করা নিঃস্বার্থ এক মানবিক গুণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো—উপকার করলেও সবাই কৃতজ্ঞ হয়ে থাকে না। অনেকেই উপকার গ্রহণের মুহূর্তে আমাদের মূল্য দেয়, কিন্তু প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে সেই মূল্যায়ন আর থাকে না। তাই বলা হয়, “মানুষের উপকার করবেন যত দিন, আপনাকে মনে রাখবে তত দিন।” এই বাক্যের ভেতরেই লুকিয়ে আছে মানব চরিত্রের এক নিরাবরণ সত্য।
তবে এখানেই শেষ নয়। প্রশ্ন আসে—তাহলে কি উপকার করা থামিয়ে দেব? মানবিকতা কি শুধুই প্রতিদানের জন্য? না, মানবিকতার সৌন্দর্য এখানেই যে আমরা প্রতিদান পাওয়ার আশায় নয়, মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে সাহায্যের হাত বাড়াই। কিন্তু সেই সঙ্গে মানতে হবে, প্রত্যাশা না রাখলে আমরা হতাশও হব না। কারণ প্রকৃত উপকার সে-ই, যার পেছনে কোনো পাওনা বা স্মরণীয় হওয়ার দাবি নেই।
সমাজে সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন বিশ্বাস, সহানুভূতি এবং আত্মিক বন্ধন। স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সম্পর্ক অস্থায়ী—যেমন বৃষ্টি থামলে ছাতা, বা কাজ শেষে কলম। কিন্তু আন্তরিকতার ভিত্তিতে গড়া সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী। যে সম্পর্ক মনে নয়, হৃদয়ে জায়গা করে নেয়, সেগুলো স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে যায়।
শেষ কথা হলো—মানুষের স্বার্থপরতা বাস্তব সত্য হলেও মানবিকতা হারিয়ে যায়নি। আমরা যদি উপকার করি নিঃস্বার্থভাবে, প্রত্যাশা ছাড়া, বিনিময়ে কিছু পাওয়ার আশায় নয়—তবে আমাদের আত্ম তৃপ্তিই হবে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। মানুষ স্মরণ করুক বা না-করুক, আমাদের কাজই আমাদের পরিচয়, আর মানবিকতাই আমাদের সত্যিকারের সম্পদ।

0 Comments