Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

হেমন্তে গ্রামের কৃষক জীবন

হেমন্তে গ্রামের কৃষক জীবন

কার্তিকের শেষ দিক, হেমন্তের মাঝামাঝি—বাংলার প্রকৃতির এক অপরূপ সংযোগকাল। সকালবেলার কুয়াশা ভেদ করে যখন প্রথম রোদের আলতো স্পর্শ মাটিকে জাগিয়ে তোলে, তখন গ্রামের জীবন যেন নতুন ছন্দে নেচে ওঠে। এই সময় কৃষকের ব্যস্ততার যেন শেষ নেই। কোথাও ধান কাটার তাড়াহুড়া, কোথাও আবার নতুন সবজির বীজতলা তৈরি। মাঠজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে কর্মযজ্ঞের উচ্ছ্বাস, জীবনের অনন্ত স্রোত।
ছোটবেলায় আমাদের গ্রামেও এমনই ছিল হেমন্তের রূপ। কৃষকের চোখে লক্ষ্য করতাম খুশির দীপ্তি, ফসলের ঘ্রাণে ভরে উঠত উঠোন, খেজুর রসের হাঁড়ি বসত ভোরের আগে। ধানের শীষ দুলে উঠলে গ্রামের প্রতিটি মানুষ যেন উৎসবে মেতে উঠত। সেই সময়ের কৃষক ছিল স্বপ্নবাজ; মনে শান্তি, পরিশ্রমে আশা আর ফলনে আনন্দ। ফসল ঘরে তোলার মধ্যেই যেন তারা খুঁজে পেত জীবনের সার্থকতা।

কিন্তু সময় বদলে গেছে। সেই পরিচিত গ্রাম, সেই পরিচিত হেমন্ত যেন আজ কোনো অচেনা মুখ। তিন দশক ধরে বাড়ির বাইরে থাকার পর যখন গ্রা‌মে ফিরে যাই, মন খুঁজে পায় না আগের সেই উচ্ছ্বাস। কৃষকের মুখে আজ আনন্দের বদলে শঙ্কা, ক্লান্তি আর অবমূল্যায়নের দাগ।
ফসলের ন্যায্য দাম নেই—এই বেদনা তাদের বুকের ভিতর গভীর ক্ষতের মতো। দিনের পর দিন রোদে-পুড়তে-পুড়তে যে মানুষ অন্যের মুখে আহার তুলে দেয়, সেই মানুষের নিজের মুখে হাসি শুকিয়ে আসে বাজারের অবিচারে।

আগে যেখানে কম সার-কীটনাশকেই জমি উর্বর থাকত, এখন সেখানে দিনকে দিন বাড়ছে রাসায়নিকের ওপর নির্ভরতা। উৎপাদন খরচ বেড়ে চলেছে, অথচ ফসল বিক্রি করে লাভ তো দূরের কথা—মূলধনটুকু তুলতেই হিমশিম খায় কৃষক। নিচে পড়ে যায় তাদের স্বপ্ন, উপরে উঠে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের লাভের পাল্লা। অথচ এই সমস্যা দেখার, সমাধানের মতো দায়বদ্ধ দৃষ্টি কোথাও দেখা যায় না।

উন্নত দেশগুলো যখন কৃষিকে শিল্পের মর্যাদায় উন্নীত করেছে, আমরা তখনও কৃষকের আশা-হতাশার দোলাচলে আটকে আছি। দেশের মাটি, দেশের প্রাণ—এই কৃষক আজও অবহেলিত, আজও নীরব সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ভিজে বৃষ্টিতে, পুড়ে রোদে; কিন্তু তাদের খোঁজ নেয় কয়জন? কতটা মূল্যায়ন করি আমরা সেই শ্রমের, যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের পতাকা, আমাদের সভ্যতা?

তবুও হেমন্ত আসে।
তবুও কৃষক ফসলের ক্ষেতে দাঁড়িয়ে নতুন স্বপ্ন দেখে।
মাটির গন্ধে তার মন আজও খুঁজে ফেরে সেই হারানো দিনের আনন্দ, যখন হেমন্ত এলেই গ্রাম জুড়ে বইত খুশির বন্যা।

হেমন্তের শিশিরভেজা এই গ্রামবাংলা আজও আমাদের মনকে টানে। ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় সেই অতীতে—যেখানে কৃষকের মুখে ছিল পরিতৃপ্তির হাসি, যেখানে প্রকৃতি আর মানুষের সম্পর্ক ছিল প্রাণের সম্পর্ক। হয়তো সময় বদলেছে, বাস্তবতা কঠিন হয়েছে, তবুও সেই স্মৃতিগুলো আজও হৃদয়কে ভরিয়ে দেয় এক স্বর্গীয় সুখে।

হেমন্ত তাই শুধু ঋতুর নাম নয়—এ যেন কৃষকের স্বপ্ন, সংগ্রাম ও অবিচ্ছিন্ন আশার প্রতীক। যত পরিবর্তনই আসুক, এই ঋতুর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে গ্রামের প্রাণের ধ্বনি, যে ধ্বনি আজও বলে ওঠে—মাটি বেঁচে আছে, মানুষ বেঁচে আছে, স্বপ্নও বেঁচে আছে।

Post a Comment

0 Comments